৫ বছর পর বরিশালে গেলেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামীলীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। বৃহত্তর দক্ষিণাঞ্চল তাঁর চেনা জনপদ। এখানকার মানুষের দুঃখ-দর্দশা তিনি আশৈশব দেখে বেড়ে উঠেছেন। শুক্রবার (২৯ ডিসেম্বর) দুপুরে বরিশাল নগরের বঙ্গবন্ধু উদ্যানে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত নির্বাচনী জনসভায় ভাষণ দেন তিনি। শেখ হাসিনার এই ভাষণের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে আত্মবিশ্বাসী এক অবয়ব। কেননা চিরচেনা এই অঞ্চল নিয়ে তাঁর অনেক স্বপ্ন আর প্রতিশ্রুতিই আজ বাস্তব হয়ে উঠেছে।
রাজধানী ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলকে যুক্ত করতে সরকারের সবচেয়ে বৃহৎ যে প্রকল্প ‘পদ্মাসেতু’, সেটি অনেক আগেই উদ্বোধন হয়েছে। কেবল দক্ষিণাঞ্চলের ক্ষেত্রেই নয়, গোটা দেশের অর্থনীতির গতি-প্রকৃতিই পাল্টে গেছে এই একটি সেতুর বদৌলতে। দেশি-বিদেশি অনেক ষড়যন্ত্র অতিক্রম করে শক্ত হাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে তাঁর সক্ষমতার সবটুকই প্রমাণ করেছেন। আজ তিনি সেই মানুষদের মুখোমুখি হয়েছেন, যাঁরা এই সেতুর সুবিধাভোগী। বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের অনেকগুলো জেলার বাসিন্দারা আজ দিনে ঢাকায় যাত্রা করে আবার দিনেই বাড়ি ফেরেন। সেই সুবিধাভোগী মানুষদের সামনে এক প্রত্যয়ী-আত্মবিশ্বাসী শেখ হাসিনা আজ প্রাণ খুলে কথা বলেছেন।
বিরোধীদের নিয়ে রাজনীতিকসুলভ বক্তব্য থাকলেও দক্ষিণাঞ্চলবাসীর জন্য এক উজ্জ্বলতর আগামীর স্বপ্নও তিনি দেখিয়েছেন। পদ্মাসেতু থেকে বাস্তবায়ন হওয়া ভাঙা এক্সপ্রেসওয়ের প্রান্ত থেকে তিনি কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকত অবধি ৬ লেনের মহাসড়ক উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তাঁর এই উচ্চারণ নির্বাচনপূর্ব বক্তব্য হলেও সমাবেশে অংশ নেওয়া বিপুল সংখ্যক উপস্থিতির জোর করতালিতে শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানানোর যে ভাষা প্রকাশ পেয়েছে তাতে দক্ষিণাঞ্চলবাসীর আস্থার কথাই তাতে স্পষ্ট হয়েছে। সমাবেশে শেখ হাসিনা আগামী নির্বাচনে উপকারভোগী জনগণের পুনর্বার সমর্থন ও ভোট প্রত্যাশা করেছেন।
আমরা জানি, নদ-নদীবেষ্টিত দক্ষিণাঞ্চল সম্ভাবনার এক বিরাট আধার। কিন্তু বহুযুগ ধরে মৎস্যসম্পদ আহরণ ছাড়া এই অঞ্চলের বহুমূখি আর্থিক সম্ভাবনার ক্ষেত্র উন্মোচেনের প্রচেষ্টা আমরা ইতিপূর্বে দেখিনি। অঞ্চলভিত্তিক যে স্বাতন্ত্র্য দক্ষিণাঞ্চলের রয়েছে, এর উপযোগী শিল্পায়নের সুচিন্তিত পরিকল্পনা কিছুকাল আগ পর্যন্ত আমরা লক্ষ্য করিনি।
গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার মধুমতি তীরবর্তী জনপদে জন্ম নেওয়া বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তাঁর শৈশব-কৈশোর ও পরিণত জীবনেও দক্ষিণাঞ্চলের নদীবিধৌত জনপদে বার বার গেছেন। তাঁর বহু স্বজনদের আবাস ছড়িয়ে ছিটিয়ে দক্ষিণাঞ্চলজুড়ে। আমরা তাঁর স্বভাবসুলভ সারল্যে লক্ষ্য করেছি, উন্নয়নের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা গোটা দক্ষিণাঞ্চলবাসীকেই তিনি স্বজনের ঔদার্যে বিবেচনা করেছেন। হয়তো সেই মমত্বের জায়গা থেকেই পিছিয়ে থাকা এই জনপদের উন্নয়নে তিনি আপনহস্তে অগণিত প্রকল্প গ্রহণ করেছেন এবং সেসবের বাস্তবায়নে বার বার সংশ্লিষ্টদের তাগিদ দিয়েছেন। হয়তো সেকারণেই অজস্র ছোট-মাঝারি অত্যাধুনিক সেতু ও চকচকে সড়কের বিন্যাসে গোটা দক্ষিণাঞ্চলই আজ সংযুক্ত।
জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনে প্রধান বিবেচনা হচ্ছে-পিছিয়ে পড়াদের উন্নয়নের মূলস্রোতে যুক্ত করা এবং তাদের জীবনমানের পরিবর্তন ঘটানো। বিশ্বের বৃহৎ বদ্বীপ হিসেবে বাংলাদেশের এমন অনেক পিছিয়ে পড়া অঞ্চলই আজ উন্নয়নের মূলস্রোতে সমান তালে এগিয়ে চলছে। এটি বললে অত্যুক্তি হবে না যে, বর্তমান সরকারের গত তিন বারের ধারাবাহিকতায় এই অভূতপূর্ব পরিবর্তন সম্ভব হয়েছে। শেখ হাসিনা আজকের সমাবেশে প্রদত্ত ভাষণে এও উল্লেখ করেছেন যে, সমতাভিত্তিক উন্নয়ন দর্শনের নীতিগত অবস্থানের কারণেই বৃহত্তর দক্ষিণাঞ্চলে অর্থনৈতিক অঞ্চল থেকে শুরু করে নৌঘাঁটি ও সেনানিবাসও স্থাপিত হয়েছে।
নির্বাচনপূর্ব সমাবেশে শেখ হাসিনা প্রত্যয়ী ভাষণে ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনার কথা আমরা জানতে পারলাম। তবে যে বিবেচনাটি এই সময়ে প্রবলভাবেই জনসাধারণের পর্যায় থেকে উঠে আসছে তা হলো; একজন শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত ঔদার্যে এই অঞ্চলের যে আমূল বদলে যাওয়ার উপাখ্যান সৃষ্টি হয়েছে, সে জায়গাতে তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা সেখানে কতোটা দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে পেরেছেন? আমরা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে লক্ষ্য করেছি, দেশের অনেক এলাকার মতোই এই জনপদেও দলীয় অন্তর্কান্দলে দলীয় প্রধানকে বার বার বিব্রত হতে হয়েছে। দলের অনেক নেতার বিরুদ্ধে উঠা নানা অভিযোগও কম নয়।
দেশের উন্নয়নের সারথি হিসেবে তাঁর অতিগুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য পালনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সেসব অন্তর্কলহ নিরসনে উদ্যোগী হতে হয়েছে। এবং এই প্রবণতা নির্বাচনকে সামনে রেখে আরও প্রবল মাত্রায় আমরা দেখতে পাচ্ছি। এমন বাস্তবতায় ‘দুষ্টু গরুর চেয়ে শুন্য গোয়াল ভালো’ নীতি বেছে নেওয়া ছাড়া দলীয় প্রধানের হয়তো কোন বিকল্প থাকবে না। আমরা সাম্প্রতিক বছরে বরিশাল সিটি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ে শেখ হাসিনাকে কঠোর হস্ত হতে কুণ্ঠিত হতে দেখিনি।
জনগণের প্রত্যাশা, গণবিরোধী তৎপরতায় দলের মান ক্ষুণ্ন করবে, এমন কাউকেই তিনি ছাড় দেবেন না। বিশেষ করে, শেখ হাসিনা ম্যাজিকে বদলে যাওয়া দক্ষিণাঞ্চলে আওয়ামীলীগের মনোনয়নে যাঁরা জাতীয় নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তাদেরও দলীয় প্রধানের প্রত্যয়ের সঙ্গে সংহতি থাকা সমানভাবেই জরুরি। যাতে কিছুতেই এগিয়ে যাওয়া এই অঞ্চলটি ফের পিছিয়ে না পড়ে।